স্মরণীয় জয়ে মাশরাফিকে ‘বিদায়’

বিদায়ী ম্যাচে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে জয় উপহার দেওয়ার প্রতশ্রিুতি দিয়েছিলেন তার সতীর্থরা। নিজেদের সেই প্রতিশ্রুতি কী দারুণ ভাবেই না রক্ষা করলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। ব্যাটে-বলে দাপট দেখিয়ে মাশরাফিকে বিদায় উপহার হিসেবে এনে দিলেন ৪৫ রানের দারুণ এক জয়। বাংলাদেশের ৯ উইকেটে ১৭৬ রানের জবাবে শ্রীলঙ্কা ১৩১ রানে অল আউট। মাশরাফিকে বিদায়ী উপহার দেওয়ার সঙ্গে স্মরণীয় এই জয়ে বাংলাদেশ দুই ম্যাচের টি-টুয়েন্টি সিরিজটাও ড্র করল ১-১ ব্যবধানে।
টেস্ট সিরিজের পর ওয়ানডে সিরিজেও ১-১ ড্র। টি-টুয়েন্টি সিরিজটাও ড্র করে এবারের শ্রীলঙ্কা সফরটা সাফল্যের রঙে রাঙিয়ে তুলল বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবারের জয়ে শ্রীলঙ্কার মাটিতে একটি প্রথম এরও জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার মাটিতে টি-টুয়েন্টিতে এটাই বাংলাদেশের প্রথম জয়। এই প্রথম এর কীর্তিতে মাশরাফির টি-টুয়েন্টি ক্যারিয়ারের শুরু আর শেষটাও মিলে গেল এক বিন্দুতে। ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচে জয়, জয় শেষ ম্যাচেও।
তবে সেই মিলটা শুধু দলীয় সাফল্য বিবেচনাতেই। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে মাশরাফি শেষ ম্যাচটায় থাকলেন প্রথম ম্যাচের ছায়া হয়ে। ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর টি-টুয়েন্টি অভিষেক ম্যাচেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশকে ৪৩ রানের জয় এনে দিয়েছিলেন মাশরাফি। সেটা ছিল বাংলাদেশেরও প্রথম টি-টুয়েন্টি। তো দেশের প্রথম টি-টুয়েন্টির ওই জয়ে মাশরাফিই ছিলেন বড় নায়ক। ব্যাট হাতে ২৬ বলে ৩৬ রান করার পর বল হাতেও এক উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।
শেষ ম্যাচে ব্যাট হাতে গোল্ডেন ডাক! বল হাতে ১ উইকেট নিয়েছেন বটে; তবে তার আগেই বাংলাদেশের জয়ের চিত্রনাট্য তৈরি হয়ে গেছে। তখন শুধু জয়কে মুঠোবন্ধী করার অপেক্ষা। তাতে কী! বিদায়ী ম্যাচে দলের দারুণ জয়ে অবদান রাখাটাই বা কম কিসের! ব্যক্তি মাশরাফি কতটা অবদান রাখলেন সেটা বড় ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হলো, দল তার বিদায়ী ম্যাচে দাপটের সঙ্গে ছিনিয়ে এনেছে অসাধারণ এক জয়। আর সেই জয়ের পথে দলকে সঠিক পথেই পরিচালনা করেছেন মাশরাফি।

জয় করায়ত্ব করে সতীর্থদের মধ্যমণি হয়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন মাশরাফি। ক্যারিয়ারের শেষ টি-টুয়েন্টি ম্যাচে মাঠ ছাড়লেন বিজয়ীর বেশে। বীরের বেশে। জয়ের মুকুট পরে কজনই বা ক্যারিয়ারের ইতি টানতে পারেন!
মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচে সিরিজ বাঁচানো জয়ের বড় নায়ক সাকিব আল হাসান। হয়েছেন ম্যাচসেরা। ব্যাট হাতে ৩১ বলে দলেল পক্ষে সর্বোচ্চ ৩৮ রান করার পর বল হাতে নিয়েছেন ৩ উইকেট। সেই ৩টি উইকেটও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৭ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নামা শ্রীলঙ্কা শিবিরে ইনিংসের প্রথ ওভারেই আঘাত হানেন সাকিব। দ্বিতীয় বলেই সাকিব উপড়ে ফেলেন আগের ম্যাচে ৭৭ রানের ইনিংস খেলে শ্রীলঙ্কাকে জিতিয়ে দেওয়া কুশল পেরেরা। এই উইকেট উৎসবের রেশ না কাটতেই আবারও সাকিবের উল্লাস। নিজের দ্বিতীয় এবং ইনিংসের তৃতীয় ওভারে শ্রীলঙ্কার অন্য ওপেনাপর দিলশান মুনাবিরাকেও ফিরিয়ে দেন সাকিব। শ্রীলঙ্কার রান তখন ২ উইকেটে ১৯। বাংলাদেশের জয়ের প্রেক্ষাপটা তৈরি হয়ে যায় তখনই!
এরপর অধিনায়ক উপুল থারাঙ্গা ও চামারা কাপুগেদারার ২১ রানের জুটিতে ৪০ এ পোঁছায় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই ৪০ রানে দাঁড়িয়েই শ্রীলঙ্কা হারায় আরও ৩টি উইকেট। নিজের প্রথম ওভারেই থারাঙ্গাকে ফেরান মাহমুদউল্লাহ। প্রথম বার বল হাতে নিয়ে মোস্তাফিজ তো প্রথম দুই বলেই পেয়ে যান দুই উইকেট। পরপর দুই বলে আসেলা গুনারত্নে ও মিলিন্দা সিরিওয়ার্দানেকে ফিরিয়ে দিয়ে মোস্তাফিজ জাগিয়ে তুলেছিলেন হ্যাটট্রিক সম্ভাবনাই। কিন্তু লাসিথ মালিঙ্গার মতো তার সেই স্বপ্নটি পূরণ হতে দেননি থিসারা পেরেরা।
মোস্তাফিজের জোড়া আঘাতের ফলে ৪০ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলে শ্রীলঙ্কা। এরপর কাপুগেদারা ও থিসারা পেরেরা জুটি শঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে চাইছিল বটে; কিন্তু ইতিমধ্যেই কলম্বোর ম্যাচটাকে নিজের ম্যাচ বানিয়ে ফেলা সাকিব তা হতে দেবেন কেন! থিসারা পেরেরাকে ফিরিয়ে দিয়ে সাকিব তাই গুঁড়িয়ে দেন তাদের ৫৮ রানের জুটি। ২৭ রান করে থিসারার বিদায়ের সঙ্গে ভেস্তে যায় লঙ্কানদের জয়ের ক্ষীণ আশাও। জয়ের পথে বাকি কাজটুকু সারতে মাশরাফি নেন ১ উইকেট। মোস্তাফিজ আরও দুটি। সব মিলে ৩ ওভারে ৪ উইকেট নিয়ে মোস্তাফিজই ম্যাচের সেরা বোলার। একটি করে উইকেট নিয়েছেন অভিষিক্ত মেহেদী এবং মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনও। তারা দুজনেই পেয়েছেন আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে প্রথম উইকেটের স্বাদ। তবে মেহেদী অভিষেক ম্যাচেই। পেস অল রাউন্ডার হিসেবে দলে ঢোকা সাইফউদ্দিন তা পেলেন দ্বিতীয় ম্যাচে। সাইফউদ্দিন ভিকুম সঞ্জয়াকে ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যদিয়ে ১৩১ রানেই থেমে যায় শ্রীলঙ্কার ইনিংস।
এর আগে টস জিতে নিজের বিদায়ী এবং সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথমে ব্যাটিং নেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। সেই সুবাদে বাংলাদেশ ৯ উইকেট হারিয়ে সংগ্রহ করে ১৭৬ রান। সৌম্য সরকার ও ইমরুল কায়েস উদ্বোধনী জুটিতেই তুলে ফেলেন ৭১ রান। সেটাও মাত্র ৬.২ ওভারে। সৌম্য-ইমরুলের এনে দেওয়া এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এক পর্যায়ে প্রথম ১০ ওভারেই বাংলাদেশ তুলে ফেলে ১০১ রান। ১২ ওভারে ১১৮। কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে তখন বাংলাদেশের স্কোর প্রথম বারের মতো ২০০ পেরোনোরই আভাস। কারণ তখনো ৮ ওভার বাকি, হাতে ৮টি উইকেট। কিন্তু ২০০ ছোঁয়া তো হলোই না, হলো না লঙ্কানদের বিপক্ষে এর আগে করা সর্বোচ্চ ১৮১ পেরিয়ে যাওয়াও। বাংলাদেশের ইনিংস বরং আটকে যায় ১৭৬ রানেই। লাসিথ মালিঙ্গার হ্যাটট্রিক জাদুর কারণে শেষ ৮ ওভারে বাংলাদেশ তুলতে পেরেছে মাত্র ৫৮ রান। হারায় ৭টি উইকেট।

কোমরের চোটের কারণে মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচে নেই তামিম ইকবাল। তার পরিবর্তে একাদশে ঢুকেছেন ইমরুল কায়েস। সৌম্যর সঙ্গে ইনিংস ওপেন করেন তিনিই। সৌম্য-ইমরুল দারুণ একটা সূচনাই এনে দিয়েছিলেন দলকে। কিন্তু মসৃণ সেই পথ চলায় হঠাৎই ছন্দপতন। যুগপত প্যাভিলিয়নে ফিরে যান সৌম্য-ইমরুল দুজনেই। সৌম্যকে ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের দুর্দান্ত ওপেনিং জুটিটা ভাঙেন আসেলা গুনারত্নে। একটু পর ইমরুল রান আউট। আউট হওয়ার আগে সৌম্য ১৭ বলে ৩৪ ও ইমরুল ২৫ বলে করেছেন ৩৬ রান। দুই ওপেনারকে এক সঙ্গে হারানোর পরও রানের চাকা ঠিক রেখেছিলেন সাব্বির রহমান ও সাকিব আল হাসান। তৃতীয় উইকেটে দুজনে ৪৬ রানের জুটি গড়ে বড় সংগ্রহের ইঙ্গিতই দিচ্ছিলেন। কিন্তু দলকে ১২৪ রানে রেখে সাব্বিরের বিদায়ের পরই মোড়ক লাগে বাংলাদেশ ইনিংসে। ১৮ বলে ১৯ রান করা সাব্বিরকে বিদায় করেন ভিকুম সঞ্জয়া। একটু পর ৩১ বলে ৩৮ রান করা সাকিবও আউট। তাকে বোল্ড করে দেন নুয়ান কুলাসেকারা। তার খানিক পর মোসাদ্দেককে ফেরান থিসারা পেরেরা।
এরপরই মালিঙ্গার হ্যাটট্রিক ম্যাজিক। যার শুরুটা মুশফিকুর রহীমকে দিয়ে। এক ছক্কা এক চারে ৬ বলে ১৫ রান করে মুশফিক বোল্ড। পরের বেলে মাশরাফিও বোল্ড। নিজের বিদায়ী ম্যাচে আজন্ম লড়াকু মাশরাফি গোল্ডেন ডাক! ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে শূন্য রানে আউট হয়ে মাশরাফি স্মরণ করিয়ে দেন ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচিত স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে। মাশরাফিকে বিদায় করে দিয়ে মালিঙ্গা দাঁড়িয়ে যান হ্যাট্রিকের দরজায়। অভিষিক্ত মেহেদী হাসান মিরাজ লঙ্কান পেসারের সেই আশা পূরণ করে দিয়েছেন। অভিষেকেই গোল্ডেন ডাক মেরে! বেচারা মালিঙ্গা। হ্যাট্রটিকের ম্যাচেও ম্যাচের সেরা না। হারা দলের সদস্য। তবে এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে ম্যান অব দ্য সিরিজ যে তিনিই!
মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচটা বাংলাদেশের বাঁচা-মরার। হারলে সিরিজে ২-০ তে হোয়াইটওয়াশ হতে হতো। উল্টো দারুণ জয়ে মাশরাফির দল গড়ল গর্বের ইতিহাস। শ্রীলঙ্কার মাটিতে গিয়ে টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টুয়েন্টি তিন সিরিজেই ১-১ ড্র। বাংলাদেশ বুক ফুলিয়ে বলতেই পারে-আমরা এখন আর ছোট দল নই!

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর